নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ইতিহাসে বাজেটের আগে এ রকম বিরূপ পরিস্থিতিতে আর কখনও পড়তে হয়নি সরকারকে। মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতির যখন একেবারে বেহাল দশা, ঠিক সে প্রেক্ষাপটে আসতে যাচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট। এই করোনার কারণে সরকারকে আসন্ন বাজেটে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সাহসি বাজেট দিতে হচ্ছে। রাজস্ব আয়ের বিশাল লক্ষমাত্রা অর্জনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। সর্বোচ্চ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট দিতে হচ্ছে এবার। এ রকম অনেক ঝুঁকি থাকছে আসন্ন বাজেটে। এই ঝুঁকির বাজেটে এবার জিডিপির আকার বাড়ছে ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার।
এদিকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এবার বাজেটের আকার তথা মোট ব্যায় ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ন্যায় বাজেটের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার।
এ অবস্থায় করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে শঙ্কা থাকলেও আগামি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির চলতি বাজারমূল্য ধরা হচ্ছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রয়েছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামি অর্থবছরের জিডিপির আকার ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বাড়ছে। তা ছাড়া আগামি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। একই লক্ষ্য ছিল চলতি বছরেও। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া নতুন মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৩২৬ ডলার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে, যা চলতি বাজেটে রয়েছে ২ হাজার ১৭৩ ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশাল এই জিডিপির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, ধীরে ধীরে পৃথিবী আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। করোনা ভাইরাসের টিকাও আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ‘করোনা সঙ্কট’ খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। এই হিসাব ধরেই আগামি বাজেটের জিডিপির চলতি বাজারমূল্য ঠিক করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগামি অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি ধরা হলে তা হবে অবাস্তব। কারণ আমাদের রফতানি ভালো না। উৎপাদনশীল খাতের সাপ্লাই চেইনে সমস্যা। রফতানির পাশাপাশি আমদানিতে সমস্যা। এগুলো ঠিক না হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো হবে না। তিনি আরও বলেন, সরকার আগামি বাজেটে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার যে রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেটিও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই মহামারি করোনাকালে এত বড় লক্ষ অর্জ করা মোটেই সম্ভব না।
জিডিপি বলতে বোঝানো হয়ে থাকে, একটি দেশের ভেতর সব রকম দ্রব্যের উৎপাদন ও সেবামূলক কাজের মূল্যভিত্তিক যোগফল। করোনার আঘাতে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার আগে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল উল্লেখ করার মতো। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। উৎপাদন থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানি প্রায় থমকে আছে। এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। অর্থ মন্ত্রণালয় বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সংশোধন আনে।
চলতি অর্থবছরে জিডিপির চলতি বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। করোনা ভাইরাস আঘাত হানলে সংশোধিত বাজেটে ৮০ হাজার ১৭২ কোটি টাকা কমিয়ে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করা হয়। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.২ শতাংশ থাকলেও তা কমিয়ে ৫.২ শতাংশ করা হয়। আগামি অর্থবছরে অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে এমনটা ধরে নিয়ে নতুন বাজেটে আবারও বড় লক্ষ্য দিতে যাচ্ছে সরকার। চলতি বাজারমূল্যে এর পরিমাণ ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সংশোধিত চলতি বাজারমূল্য থেকে এটি তিন লাখ ৬৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা বেশি। সে হিসাবে আগামি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮.২ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ববোর্ড সূত্র জানায়, আগামি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হতে পারে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটে ধরা হয় তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর রাজস্বের লক্ষ্য ধরা হতে পারে তিন লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটে রয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হবে ১০ লাখ ৬১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্য রয়েছে নয় লাখ ৪৬ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগামি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য রয়েছে সাত লাখ ৯২ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। যেটি চলমান বাজেটে রয়েছে ছয় লাখ ৯৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হতে পারে দুই লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এটি রয়েছে দুই লাখ ৪৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।